পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৫)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২১ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:৪৩:৫৮ রাত
মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা তার গ্রামের পাট চুকানোর আগেই এই গ্রামে একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যায়। আজ তোমাকে সেই ঘটনা বলছি।
আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন রশিদ খলীফা। এদের বংশ হল খলীফা।এই লোকের তিন ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেরা কেউ পড়ালিখা করে নাই। স্কুলের গণ্ডী ও পার হয় নাই। গঞ্জে কয়েকটি বড় দোকান আর আড়ত রয়েছে। সেগুলোই ভাগ করে তিন ছেলে দেখাশুনা করে। বড় ছেলে আর মেঝ জন ছোট ছেলের থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে সেই ভালো এতটা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল গ্রামবাসীর জন্য, যে তারা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। আর ছোটজন ছিল সাক্ষাৎ শয়তানের এজেন্ট। এই ছোট ছেলেটি ওর বাবার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে আসছিল। সে দলবেঁধে এলাকায় ঘুড়ে বেড়াতো। পথে যে কেউ সে যে বয়সেরই হোক না কেন, তাকে সালাম না দিলে সে নির্যাতন করত, মারত, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মাটির রাস্তা এবং বাশের সাঁকো দিয়ে রাস্তাগুলো সংযুক্ত ছিল, সেই সময়েও সে একটি হোন্ডা মটর সাইকেল তার বাবাকে দিয়ে শহর থেকে কিনিয়ে আনে। আর এটায় করে যতটুকু পথ চলা যায়, টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। সাঁকোর কাছে এলে সেখানে রেখে আবার ফিরে যায়, কখনো নৌকায় করে বাইকটি ওপারে নেয়। এভাবেই সে অন্য ধরণের এক রাজত্ব তৈরী করে নিয়েছিল। সে হয়েছিল ক্ষমতাধর অত্যাচারী রাজা।
গ্রামের এক গরীব চাষী ছিলেন মকবুল। তার এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেটি মেঝ। ওর বড় এক বোন এবং সবার ছোট অন্য বোনটি। ছেলেটির নাম হারুন। বড় মেয়ে মর্জিনা। ছোটটি পারুল। এই বড় মেয়েটি সেবার গ্রামের স্কুল থেকেই এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। আর ছেলেটি ওর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালিখা শেষ করে আর পড়ে নাই। ছোট বোনটি এখনো স্কুলে ভর্তি হয় নাই। সারাদিন খেলাধুলা করে সময় কাটায়। আর ওদের মা ওদের ঘর সামলায়। দিনভর পরিশ্রম করে মকবুল। নিজের ছোট এক টুকরা ক্ষেতে কাজ করে কতটুকুই বা আর ফসল পায়। তা দিয়ে ওদের সারাবছরের খোরাক আসে না। এজন্য হারুণ বাবাকে সাহায্য করতে পড়ালিখার পাট চুকায়। আর অন্যের ক্ষেতে দুই বাপ-বেটা কামলাও দেয়া শুরু করে। একজন কৃষক পরিণত হয় ক্ষেত মজুরে। আর মকবুলের বউ চেয়ারম্যান বাড়ি কাজ করে পার্ট টাইম। সেখানে চেয়ারম্যানের অন্য ভাইদের লালসার শিকার হয়ে প্রতিদিন অসহ্য কষ্টে কাটে মকবুলের বউ সালেহা বেগমের। তাকে কথা এবং চোখের দ্বারা প্রতিমুহূর্তে ভোগ করতে থাকে - দুর্ভোগে যাতনায় দোযখবাস করাতে থাকে চেয়ারম্যানের মেঝ ভাই। কিন্তু সব নিরবে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া সালেহা বেগমের গতি থাকে না। দু:খের দিন - যত ধীরেই হোক সময় বয়ে যেতে থাকে।
চেয়ারম্যানের ছোট ছেলের চোখ পড়ে মর্জিনার উপর। সে মর্জিনাকে খারাপ প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মর্জিনা ছিল দৃঢ় মনের অধিকারিনী। একদিন স্কুলে অন্য বান্ধবীদের সাথে যাবার সময়ে এই ছেলেটি যার নাম রতন, সে মর্জিনার পথরোধ করে। ছেলেটির সাথে ওর দুজন চামচা ছিল। রতনের ভয়ে মর্জিনার অন্য বান্ধবীরা মর্জিনাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন ঐ নির্জন গাছগাছালি ঘেরা পথে ছেলেটি মর্জিনাকে অনেক টানাটানি করে। কিন্তু ওরা নেশাগ্রস্ত থাকাতে মর্জিনা ওদেরকে আঁচড়ে খামছে পালাতে সক্ষম হয়।
মিথিলা বাবু!
সেই সময়ে ঐ পথ দিয়ে তোমার দাদু আসছিলেন। ভীত উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে যাওয়া মর্জিনা তার সামনে পড়ে। তখন ওকে জিজ্ঞেস করে তিনি সব জানতে পারেন। সেদিন বিকেলে মকবুলের বাড়িতে আব্বা এবং আরো কয়েকজন গ্রামবাসী মকবুলকে নিয়ে আলোচনায় বসে। মর্জিনা ওর সাথে যা হয়েছে ,সব জানায়। উপস্থিত সবাই ক্ষিপ্ত হলেও নিজেদের অসহায় অবস্থায় কি করতে পারবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বাবা ঘটনাটি চেয়ারম্যান সাহেবকে জানাতে চায়। একটা ছোটখাট সালিশের ব্যবস্থাও করার জন্য মনে মনে ঠিক করেন। পরেরদিন বিকেল বেলা চেয়ারম্যান বাড়িতে সালিশ বসে।
সেখানে মর্জিনা রতনের ব্যাপারে সব সবার সামনে বলে। প্রথমে ভিতরে ভিতরে ক্ষিপ্ত চেয়ারম্যানের চেহারায় রাগ থাকলেও তা মুখের কথায় বলে নাই । ছেলেটি সব অস্বীকার করে। কিন্তু মর্জিনা যখন ছেলেটির গালে, গলায় ওর হাতের নখের দাগ দেখিয়ে জানায় সে বাঁচার জন্য যখন চেষ্টা করছিল, এগুলো তখন হয়েছে- চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে বোমার মত সশব্দে ফেটে যায় , ' তোর এতো বড় সাহস! ছোট লোকের মেয়ে হয়ে তুই আমার ছেলের গায়ে হাত দিছিস!
এ কথায় আব্বা খুবই অবাক হন। তিনি প্রতিবাদ করেন। দৃঢ় স্বরে বলেন,' এইটা কি বললেন চেয়ারম্যান চাচা? কে কার শরীরে হাত দিয়েছে? আপনার ছেলে এই মেয়েটিকে জোর করে নষ্ট করতে চেয়েছে, সেটাকে না দেখে মেয়েটি বাঁচার জন্য কি করেছে সেটাই দেখছেন?'এই সময় একটু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। চেয়ারম্যানের পক্ষের লোক যারা উপস্থিত ছিল তাদের একজন বলে , ' এই মাইয়াটাই ই বদের হাড্ডি। ও চেয়ারম্যান সাহেবের পোলারে ফাঁসানোর জন্য নিজেরে সামনে আগাইয়া দিছে,ওর বিচার করন দরকার '।
চেয়ারম্যানের বাকি লোকেরা তাতে সায় দেয়। এবং পুরো ঘটনাটি অন্যদিকে মোড় নেয়। বাবা এবং অন্যরা অপমানিত হয়ে ফিরে আসেন। এর দু'দিন পর মর্জিনাকে গ্রামের পশ্চিম দিকের এক বাগানে ছিন্নভিন্ন পোশাকে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ওকে মারার আগে রেইপ করা হয়েছিল। পুরো গ্রামে ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তোলে।
সদর থানা থেকে পুলিশ আসে। তারা চেয়ারম্যানের ইশারায় চলে। ওরা লোকদেখানো একটা তদন্ত করে। সেখানে মকবুল কিংবা ওদের পক্ষের লোকদের বক্তব্যকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। মর্জিনা মার্ডার কেইসটি পুলিশ ফাইলে রহস্যজনক মার্ডার কেইস রূপ ধারণ করে। বাবা এই ঘটনাটি মেনে নেন না। আর একজন এটা মেনে নিতে পারে না। সে মর্জিনার ভাই। বাবার পরামর্শে মকবুল আদালতে চেয়ারম্যানের ছেলে রতনের বিরুদ্ধে মামলা করে।অনেকদিন মামলাটি চলে। তবে আসল সময়ে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা ভাই একজন সাক্ষী হয়েছিলেন। তবে খুনের সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী কেউ না থাকাতে আর পুলিশের চার্জশীট একদম নড়বড়ে হওয়ায় মামলাটি টিকে না। এই ঘটনায় চেয়ারম্যানের চক্ষুশূল হন বাবা। আমার বড় চাচাকে ডেকে চেয়ারম্যান সাহেব সকলের সামনে অনেক অপমান করে, বাবাকে সামলানোর কথা বলে। সেদিন বাড়ি ফিরে দুই চাচা অনেক বকাঝকা করেন বাবাকে। বলেন, ' তোর জন্য কি ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা এই গ্রামে থাকতে পারব না?
এই ঘটনাটিও বাবাকে এই শেকড় ছেড়ে নির্বাসনে যেতে অনেকটা বাধ্য করেছিল । আর আমার কচি মনে , মর্জিনার সেই গলাকাটা লাশ, খুনের আসামী হয়েও রতনের বেকসুর খালাস পেয়ে গ্রামে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়া, দিনভর চেয়ারম্যান বাড়িতে উৎতসবমূখর পরিবেশ- এসব কিছু কেমন এক ঘোর লাগা অনুভূতি এনে দিয়েছিল। একটি মৃত্যু এতো সহজে ঢেকে রাখা যায় দেখে আমি ঐ বয়সেই কেমন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম।
আরো একটু চমক বাকি ছিল। মর্জিনার ভাই একদিন নেশাসক্ত অবস্থায় যখন চেয়ারম্যানের ছেলে তার এক বন্ধুকে নিয়ে মটর বাইকে করে যাচ্ছিল, খেজুর গাছ কাটা দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সাথের চামচাটিকেও গুরুতর আহত করে। শেষে নিজে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পন করে। এর রেশ মিটাতে চেয়ারম্যানের লোকেরা মকবুলের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মকবুলকে গ্রাম ছাড়া হতে বাধ্য করে। শহরে গিয়ে বাবার মুখে পরে শুনেছিলাম, মকবুলের ছেলেটির খুনের দায়ে যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছিল।
এটি সেই সময়ে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনা। তবে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এই দেশের প্রতিটি গ্রামেই এইসব সামন্তবাদী মনোভাবাপন্ন জোতদার শ্রেনি নিরন্তর এরকম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি গ্রামেই এরকম রতন এবং মর্জিনা কিংবা রশিদ খলীফা অথবা মকবুলদের এই শ্রেণি সংঘাত একইভাবে চলছে। আর এদের ভিতরকার এই দ্বন্দ্বকে না মিটিয়ে এই রাষ্ট্রযন্ত্র বরং সেটাকে নিজের প্রয়োজনে উস্কে দিচ্ছে। এই উভয় শ্রেণি যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়ি! এদের ভিতরকার এই চলে আসা সংগ্রামকে পুঁজি করেই নষ্ট রাজনীতির ধারক বাহকেরা ক্ষমতায় এসেছেন, আসছেন এবং আগামিতেও আসবেন।
আর রশিদ খলীফারা নিজেদের সাময়িক লাভের বশবর্তী হয়ে তাদের হাতের পুতুল হয়ে জীবনধারণ করে যাবে।
আমার বাবু!
আমরা তোমাদেরকে শোষণ মুক্ত একটি সমাজ দিয়ে যেতে পারি নাই। কিন্তু আমরা যে ভুল করেছি, সেগুলো দেখিয়ে দিয়ে যেতে চাই। তোমরা আমাদের মত এই ভুল পথে পা বাড়াবে না।
আজ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।
ভালো থেকো মা'মনি।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৪৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর অনুভূতি ব্যক্ত করলেন, সাথে রইলেন এবং প্রথম মন্তব্য করলেন- অনেক অনেক ধন্যবাদ রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।
সমান্তবাদি মনোভাবাপন্ন এই জোতদার ক্ষমতাবানদের অত্যাচার-নির্যাতনের ধারা ফোলে-ফেপে বিস্তার লাভ করেছে সারা দেশ ব্যাপী! ধর্মনিরপেক্ষতা আর মানবতাবাদের ফানুস পড়ে রশিদ খলিফারা আগের চেয়েও ভয়াবহ নীপিড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামী মানসিকতার মকবুলদের উপর!
অসাধারণ সাবলীলতায় উপলব্ধিকে নাড়িয়ে গেল নান্দনিক শব্দগাঁথা!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইর জানাচ্ছি শ্রদ্ধেয় মামুন ভাই!!!
আপনার নান্দনিক মন্তব্য আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়ে গেলো।
ক্ষমতাবানদের সময় ফুরিয়ে আসছে। বেশীদিন নেই যখন ক্ষমতাহীনেরা তাদেরকে সমূলে উৎপাটন করবে। অপেক্ষা করুন।
শুভকামনা রইলো।
শুভেচ্ছা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন